প্রায়ই ‘ইল্লাল্লাহ’ নিয়ে অনলাইন-অফলাইন উত্তপ্ত হয়ে উঠে । মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বারবার বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া খুবই দুঃখজনক।
এক্ষেত্রে মুনাসিব (উচিত) হল, এ বিষয়টা যেহেতু ইলমুত তাসাউফফ শাস্ত্রের, তাই ওই শাস্ত্রকে সামনে রেখেই পক্ষপাত ও বিরোধিতা করা। না হয় এ বিতর্ক শেষ হওয়ার নয়। এজন্যই যারা তাসাউফফকেই উপেক্ষা করে বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে, আমি তাদের সাথে বিতর্ক জড়ানো সঠিক মনে করি না।
অন্যান্য শাস্ত্রের মত ইলমুত তাসাউফ একটি শাস্ত্র। যা উম্মাহ’র বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামগণ শরীয়ার আলোকে প্রণয়ন করেছেন। এ শাস্ত্রের নিজস্ব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মসুচি ও কর্মপন্থা রয়েছে। আছে শাব্দিক ও পারিভাষিক বিভিন্ন পরিভাষা। আমরা অনেকেই এসব কিছু না জেনে অহেতুক বিতর্ক শুরু করি। যা অনুচিত।
এবার মুল কথায় আসা যাক-
‘ইল্লাল্লাহ’। ৬/১২ তাসবীহ নামক জিকির প্রশিক্ষণের অংশমাত্র। যা ইলমে তাসাউউফের মাশায়েখগণ সুনির্দিষ্ট নিয়মে তাদের অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। যার নাম হল নফি-ইসবাত। অর্থাৎ ক্বলব থেকে গাইরুল্লাহকে বের করে দেয়া, একমাত্র আল্লাহকেই স্থান দেয়া।
এ তাসবীহ আদায়ের সুনির্দিষ্ট একটা নিয়ম আছে। সেটা হল, প্রথমে লা ইলাহা ইল্লালাহ (এটা বলার সময় উলুহহিয়্যতের হকদার একমাত্র আল্লাহকে সাব্যস্ত করা, গাইরুল্লাহকে বাদ দেয়া খেয়াল করবে)। তারপর ইল্লাল্লাহ বলবে (এটা বলার সময় তিনি মনে মনে সংকল্প করেন যে দুনিয়ার সমস্ত কিছুর উপর একমাত্র আধিপত্য আল্লাহর) শেষে আবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে শেষ করবে।
তারপর বলবে, আল্লাহ,আল্লাহ(এটা বলার সময় একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব ব্যতীত বাকি সবকিছুকে ভুলের যাওয়ার চেষ্টা করা এবং আল্লাহকে পাওয়ার বাসনা সৃষ্টি করা।) এভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া আরও বেশকিছু তাসবীহ আছে।
উল্লেখ্য এটাকে সুন্নাহ বা ইবাদাতে মুস্তাকিল্লাহ হিসেবে দেয়া হয়না বরং রিয়াজাহ/তামরীন হিসেবে দেয়া হয়।
অর্থাৎ প্রচলিত এ পদ্ধতিটি মাসুর/মাসনুন বা ইবাদাতে মাকসুদা হিসেবে নেয়ার সুযোগ নেই। অন্যান্য শাস্ত্রের সহযোগী আমলের মত ওসায়েল হিসেবে নেয়া যায়, আসল হিসেবে নয়।
বাকি সওয়াব হওয়া না হওয়া নিয়্যাতের পরিশুদ্ধতা ও আল্লাহর মাশিয়্যতের উপর নির্ভর করবে। তবে আল্লাহর স্মরণকে মজবুত রাখার জন্য করা হচ্ছে তাই আশা করা যায়। তবে নির্ধারণ৷ করার সুযোগ নেই। কোন কাজ সুন্নাহ বা ইবাদাতে মুস্তাকিল্লাহ মনে না করে শুধু রিয়াজাহ বা প্রশিক্ষণের জন্য হলে সেটার জায়েজ হওয়ার জন্য শরিয়ার সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়াই যথেষ্ট।
এটাকে অনর্থক,অপ্রয়োজনীয়, পরিত্যাজ্য মনে করা বা বিদয়াত আখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। যারা বিরোধিতা করতে যেয়ে ঢালাওভাবে এসব শব্দ প্রয়োগ করেন তাদেরকে বিরত থাকার অনুরোধ করবো। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ সুন্নাত বা ইবাদাতে মাকসুদাহ/ মুস্তাকিল্লাহ মনে করে অথবা বলে হুবহু এ পদ্ধতি কোরআনে বা হাদিসে আছে তাহলে সেটা অবশ্যই বিদয়াত।
মোটকথা হল,মৌলিকভাবে জিকির হিসেবে কোরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত আজকার ও তাসবীহগুলোই গ্রহণযোগ্য এবং উত্তম। এতে বাড়ানো কমানোর সুযোগ নেই।
হ্যাঁ, জিকিরের প্রশিক্ষণ হিসেবে, অন্তর প্রস্তুত করার নিমিত্তে ইলমে তাসাউফফের মাশায়েখগন যেসব নিয়ম-পদ্ধতি চালু করেছেন ওইগুলোকে সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার জবাব-
কেউ কেউ বলেন এভাবে নবিজী সা.করেছেন কি না? না করলে আমরা করবো কেন? এত ঘুরানো প্যাচানোর দরকার কী? জায়েজ হলেই করতে হবে কেন? তাদের দাবি হল সবকিছুই নবিজি সা.থেকে হুবহু প্রমাণ থাকা জরুরি । পরবর্তী উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন শাস্ত্রের জন্য যেসব নিয়ম-পদ্ধতি চালু করেছে তা অনর্থক! তা বাদ দিয়ে দিতে হবে!
এ দাবি সঠিক নয়। এতে দ্বীন ও শরিয়তের বিশাল অংশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যাবে। যেমন ‘কোরআন তিলাওয়াত’ ইবাদাতে মাকসুদা। নবিজি সা.নিজে তিলাওয়াত করেছেন, সাহাবাদের করিয়েছেন। আশা করি এতে কারোই দ্বীমত থাকার কথা নয়।
কিন্তু দেখেন পরবর্তীতে কোরআন বিশুদ্ধ করে পড়ার জন্য ইলমুত তাজবিদের আবিষ্কার করা হয়েছে ,সংযোজন করা হয়েছে বহু এমন জিনিস যেগুলোর প্রামান্যতা কোরআন হাদিস থেকে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে দেয়ার ছাড়া উপায় নাই। একইভাবে বুঝার জন্য আবিস্কার করা হল কত শাস্ত্র। এখন ইল্লালাহ নাজায়েজ বেদয়াত প্রবক্তাদের মত এখানে কেউ নবী সা. করেছেন কিনা? তখন ছিল কিনা এসব অভিযোগ করে বসলে জবাব দিতে পারবো?
যেমন ধরুন আমাদের এই উপমহাদেশে কোরআনুল কারিম শিক্ষা দেয়ার জন্য কত পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে । বিশেষত নূরানী। কেউ যদি পুরো নূরানী সিস্টেমকে নবীজি সা.এভাবে করেছেন কিনা?এমন প্রশ্ন তোলে তাহলে আমরা কি জবাব দিব? নাকি এটাকেও বাদ দিয়ে দিব? এটাও তো সবাই জায়েজ বলেন,তো এটাও অনর্থক!
একইভাবে নাহু,সরফ,বালাগাত, মান্তেক সহ পুরো ওসায়েল শাস্ত্রগুলো শুধু জাওয়াযের ভিত্তিতেই মেনে নেয়া হচ্ছে,দরস ও তাদরীস চলছে। আপনার বর্ণিত উসুল অনুযায়ী কেউ এগুলোকে নিয়েও অনর্থক হওয়ার প্রশ্ন তুলে বসতে পারেন, তখন কি জবাব দিব। একই প্রশ্ন উঠানো যেতে পারে পুরো মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর,তখন?
একই অবস্থা হবে ইলমুত তাফসির,ইলমুল হাদিস সহ দ্বীনি প্রতিটি শাস্ত্রের ব্যাপারেও।
মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, ইলমুত তাসাউউফফের কোন মাশাইখই ৬/১২ তাসবীহের যে ওজিফা দেন সেটাকে সুন্নাহ দাবী করে দেননা। জাস্ট সবক হিসেবে দিয়ে থাকেন। বিশেষত মোরাকাবার সময়ে কিভাবে নিজের কলব থেকে গাইরুল্লাহকে বের করে দেয়া যায় এই প্রশিক্ষণ হিসেবে। এখন অভিযোগ কারীরা এটাকে সুন্নাহ’র মুকাবালায় দাঁড় করান,বা বিকল্প হিসেবে সাব্যস্ত করে অভিযোগ করেন। যা দুঃখজনক।
প্রতিটি শাস্ত্র তার উসলুবেই বুঝতে হবে। সবকিছুকে গুলিয়ে ফেললে হবেনা। কিছু শাস্ত্রের ক্ষেত্রে আসলাফদের থেকে চলে আসা নিয়ম মেনে নেওয়া আর কিছু শাস্ত্রের ক্ষেত্রে নিজেরা মুজতাহিদ সেজে যাওয়া ঠিক না ,তাহলে তো গোলমাল থেকেই যাবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রতিটি জিনিস যথাস্থানে রেখে আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : মুফতি শামছুদ্দোহা আশরাফী, খতিব- সাইন্সল্যাবরেটরি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, ধানমন্ডি। প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতি – রওজাতুল উলুম মাদ্রাসা মিরপুর।
Leave a Reply