নিজস্ব প্রতিবেদক:
১৮৫৭ সালে বৃটিশ কোম্পানী শাসনের বিরুদ্ধে দেশীয় সিপাহীদের যে অভ্যুত্থান ঘটেছিলো, ঐতিহাসিকদের মতে সেটি ভারতীয়দের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে খ্যাতি লাভ করেছিলো। সিপাহী বিদ্রোহে গোটা ভারত যখন কম্পমান তখন সে কম্পনের ঢেউ মৌলভীবাজার এলাকাতেও আছড়ে পড়েছিলো। চট্টগ্রামের তিন শতাধিক সীমান্তরক্ষী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতঃ সিপাহী বিপ্লবের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। চট্টগ্রামের ট্রেজারী লুট করে বিদ্রোহী সিপাহীরা কুমিল্লা হয়ে সিলেট অঞ্চলে প্রবেশ বরে। সিপাহী বিপ্লবের সময় ভারতীয় নবাব ও জমিদারদের বড় অংশ নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে তথা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং জমিদারী প্রথা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে ব্রিটিশদের পক্ষবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলো কুলাউড়াস্থ পৃথিমপাশার নবাববাড়ি। পৃথিমপাশার নবাব গৌছ আলী খান তখন বিদ্রোহী সেনাদের পক্ষাবলম্বন করে তাদেরকে রসদসহ অন্যান্য সহযোগীতা প্রদান করেন। বিদ্রোহী সৈন্যরা বড়লেখার পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। এদিকে সিলেটে অবস্থানরত ইংরেজ সেনাপতি মেজর বিং অগ্রসরমান বিদ্রোহী সৈন্যদের যাবতীয় তথ্য অবহিত হবার পর তাদেরকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে নিজ সৈন্যদল নিয়ে সিলেট থেকে প্রতাপগড়ের দিকে অগ্রসর হন। ১৮৫৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে বড়লেখার লাতুর নিকট উভয়পক্ষ মুখোমুখি হয়। বিদ্রোহী সিপাহীরা পাহাড়ের টিলার উপর অবস্থান গ্রহণ করে। বৃটিশ পক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিতে। বিদ্রোহী সিপাহীদের অভ্রান্ত নিশানার মুখে প্রথমই নিহত হন মেজর বিং। একই সাথে আরও ৮/১০ জন বৃটিশ সৈন্য নিহত হওয়ায়, বৃটিশ বাহিনী বিক্ষিপ্তভাবে পালাতে শুরু করে। যুদ্ধের এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় বৃটিশ পক্ষের হাল ধরেন নেটিভ সুবেদার অযোধ্যা সিং ও তার অনুগত গুর্খা বাহিনী। অযোধ্যা সিং এর রণকৌশলে বৃটিশ সৈন্যরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে ভারি অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে। অবিরত কামানের গোলাবর্ষনের বিপরীতে বিদ্রোহী সিপাহীদের রাইফেল দ্বারা প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা অসম্ভব হয়ে পড়ায়, স্বাধীনতাকামী সিপাহীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সিপাহীদের বড় অংশ কাছাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। একাংশ অস্ত্র ফেলে স্থানীয় ভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ঐতিহাসিক লাতুর যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগন বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। এজন্য পরবর্তীতে তাদেরকে মাশুলও দিতে হয়েছিলো বলে জনশ্রুতি আছে। সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরবর্তী বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এদেশীয় প্রেক্ষাপটকে কম বেশি আলোড়িত করেছিলো। ফকির আন্দোলন, সন্ন্যাসী আন্দোলন, ওহাবী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, তীতুমীরের নারকেল বাড়িয়ার যুদ্ধের রেশ হয়তো মৌলভীবাজারেও আছাড়ে পড়েছিলো বিক্ষিপ্তভাবে। তার অনুরণও হয়তো ছিলো। কিন্তু কালের গর্ভে তা তলিয়ে গেছে উত্তাপহীন অবস্থায়। বর্ণনার বর্ণচ্ছটায়
হয়তো তা বাঙময় হয়ে উঠেনি।
সুত্রঃ জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্বে মৌলভীবাজার। ৩৬৪ পৃষ্টা।
Leave a Reply